আবদুল হাসিব : বসন্তের উন্মুখ কৃষ্ণচুড়ার ঢলমলে রঙের মতো ঝলমলে যৌবন ছিলো মহিমের। আর সে ছিলো আসন্ন বসন্তের মঞ্জুরিত মুকুল মাত্র। তবুও প দশী এই কিশোরীর ডগমগে বাড়ন্ত শরীরে ছিলো পুরুষের চোখকে আকৃষ্ট করবার মতো এক ঐন্দ্রজালিক আকর্ষণ। তার মায়া মৃগাক্ষীর দিকে যখনই একবার থাকিয়েছে কেউ, অতৃপ্ত তৃষ্ণা রয়ে গেছে তার অনন্তকাল দেখবার। এই সেই রজস্বলা রূপশ্রীর প্রেমে মজে উঠে শ্যাম বর্ণের অষ্টাদশ বয়সী মহিম নামের এক সুদর্শন তরুণ। চলতে থাকে তারা দু’জনের নিরন্তর গোপন প্রেমাভিসার।
আমার খুব মনে পড়ে। আমিও একদিন আলেয়া’কে দেখেছিলাম। বলা যায় সে দিন আমার জীবনের এক দুর্লভ মুহুর্ত ছিলো, তা না হলে জীবনে অমল বিমল সুন্দরকে চোখের আদর মেখে হৃদয় ভরে দেখবার সুযোগ কি এতো সহজে কারো ভাগ্যে ধরে! সে দিন বাসন্তী সন্ধ্যার নরম অন্ধকার তখনও গাঢ় হয়ে নেমে আসে নি। ম্লান গোধূলি লগ্নে বিদায়ী সূর্য তার শেষ আবিরটুকু ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাখাচ্ছিলো ম্রিয়মাণ বসুন্দরার মায়াবী শরীরে। আর সেই সময় পদ্ম দিঘির ঘাটে ধীর পায়ে নামছিলো পাশের বাড়ির আলেয়া নামের সরলা মেয়েটি। এমন এক ধূলিসন্ধিলগ্নে আমি সে দিন তাকে সন্ধ্যার ঘাট সমুজ্জ্বল করে আমার দিকে বিস্ময় চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিলাম। দেখছিলাম তার সুগোল চাঁদের মতো সফেদ সুন্দর মুখ, লম্বা ভুরুর নীচে টানা টানা ডাগর দু’টো চোখের উদাস সকরুণ দৃষ্টি, আরক্তিম কবোষ্ণ ঠোঁট কামনার ভারে থর থর, বেণী খুলা এলোমেলো কালো চিকচিকে কেশরাশি, হাতের সুডৌল মসৃণ গড়ন, মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম তার কাঁচুলির বসন কী ভাবে বার বার খসে খসে পড়ে যাচ্ছিল, নগ্ন ধবল পা যোগলের নিম্নাংশের গোলাবী রঙ সে দিন এক অব্যক্ত অনুভুতির স ার সৃষ্টি করে ছিলো আমার সমস্ত বুকের ভিতর। শান বাঁধানো ঘাটের এক পাতা এক পাতা করে নেমে এসে দিঘির সচ্ছ শীতল জলে যখন সে পা ডোবায়; আমি তখন তন্ময় থাকিয়ে কেবল তাকেই নির্বাক দেখছিলাম। দেখছিলাম যেন সরোবরের বুকে সদ্য ফোটা এক শ্বেতপদ্ম তার কোরক মেলে ফেল ফেল করে চেয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু! কিন্তু সে দিন আমি যদি জানতাম, আমার মুখাবয়ব জুড়ে অন্য একটি মুখ তার চোখে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে, সে অন্য একখানা মুখ বিভোর হয়ে খুঁজছে; তা হলে কি এতো আহ্লাদে এতো আনন্দে সে দিন আমার হৃদয়টা পরম পরিতৃপ্তিতে ভরে ভরে উঠতো! Ñকিন্তু জীবনের কতোটা পথ হেঁটে আসার পর, আজও আমি তাকে শতচেষ্টায় অবহেলায় অবজ্ঞা করে ভূলে থাকতে পারলাম কই? হয়তো বা পারতাম; যদি চাঁদ না উঠতো আর নীলাভ অন্তরীক্ষের গায়ে।
জানি না জন্মের পূর্বে না পরে? সম্ভবতঃ জন্মের পূর্বেই নির্বাচিত হয়েছিলো তার এমন শ্রুতিমধুর লাবণ্যময়ী এক নাম। বিধাতা নিজেই যে নামটির মর্মার্থ রক্ষার্থে এই প্রতিমাকে নিজ হাতে সযত্নে গড়তে কার্পণ্য করেন নি। তাই মেয়েটির নাম যেমন আলেয়া তেমনি তার সমস্ত দেহকান্তি জুড়ে আলোড়ন করে রূপের ঐশ্বর্যময়ী প্লাবন।
হয়তো বা প্রথম দর্শনেই মহিম নামের ছেলেটি নবযৌবনা আলেয়া’কে গেয়ে শুনিয়েছিলো, – ‘জ্যোছনার সাথে চন্দন দিয়া/ মাখাবো তোমার গায় / রামধনু হতে লাল রঙ ছানি/ আলতা পরাবো পায়।’ নয়তো বা কবিতার সেই লাইন, -‘যতোটুকু সুন্দরতায় শরৎ রাতের শুভ্র খন্ডমেঘ/ চুমু খায় আধখানা চাঁদের ঠোঁটে/——ঠিক ততোটুকু সুন্দরতায় আছো প্রিয়া,/ আমার চোখে তুমি।’ কিংবা তো গুন গুন করে গেয়ে উঠেছিলো গালিবের নিসৃত গজলের মতো করে, – ‘তেরা চেহরা ইতনা সোহানা লাগতা হে / তেরি আগে চাঁদ পুরানা লাগতা হে—।’
তিলোত্তমা আলেয়ার এই প্রেমিককে দেখবার জন্যে আমার আকাক্সক্ষাটা বিলের বুকে কলমি লতার মতো তির তির করে যখন বেড়েই চলছে, ঠিক তখনই একদিন হঠাৎ পথে তার দেখা। প্রবল আগ্রহ নিয়ে আলাপ করে যা বুঝে উঠতে পারলাম, তাতে ওরা দু’জনের বিষয়-বাসনা গুলো আমার কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এবং নিশ্চিত হতে পারলাম, – নজরুল’র গান, কবির কবিতা কিংবা গালিব’র গজলের সুরের মূর্চনার কোন ক্রিয়াকর্ম ওখানে বিদ্ধমান ছিলো না। যা ছিলো তা হলো, – যৌবনের এমন মাহেন্দ্রক্ষণে নবযৌবনা রজস্বলার আগুন সময় পাণিপ্রার্থী হয়ে একজন যুবকের অত্যন্ত সহজ আগমন এবং নির্গমন। পাশের বাড়ির মহিমের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি, রক্তে-মাংশের দু’টি মানুষকে অধীর অস্থীর উন্মাদ উন্মাতাল করে পরম পরিণতির দিকে দ্রুত ধাবিত করছে। ওখানে এর চেয়ে আর বেশী কিছু নেই।
শরীরের ভাঁজ ভোঁজে যখন যৌবন মুকুলিত হয়, তখন দখিনা মলয় সর্বাঙ্গে শিহরণ তুলে, কামুক হৃদয় চল-চ ল হয়, তৃষ্ণাকাতর মন তখন প্রজাপতি-ই চাই। হউক সে সুশীল সুন্দর পৌরুষত্বের অধিকারী নয়তো বা কুৎসিত কুলাঙ্গার অনাহারী, তাতে কী বা আসে যায়। এমন অস্থির সময় তা বুঝবার অবকাশ কোথায়? নিবারণের প্রত্যাশায় সে যেমন পরশই হউক বাচ-বিচার নেই; শুধু স্পর্শ চাই, আলিঙ্গন চাই। এ বেলা এইটুকুর চেয়ে বেশী চাওয়ার কী বা দরকার আছে আর, এমন এক ব্যঞ্জনাময়ী ভাব কাতর করে তুলে যুবক যুবতীকে। সে যে এক দুর্বার অপ্রতিরোধ্য অনুচ্চারিত যৌবনের গান। কার সাধ্যি আছে রোধে এ গতি, স্তব্দ করে এমন গানের প্রবাহিত বিষবাষ্প সুর। যৌবনে প্রথম পরশ! আহাঃ রে! সে বড়ই মদিরাময় এক নেশা, কেটে উঠা খুবই কষ্টসাধ্য। জীবনের এমন সন্ধিক্ষণে যে কেউ যার দিকে স্পর্শের হাত বাড়িয়ে আনে, সে-ই নিগূঢ় নিবাস গড়ে একে অন্যের প্রাণের কোণে। মহিম’র জীবন্ত নিবাস আজ আলেয়া’র হৃদয় ঘরে, মহিম নড়েচড়ে, মহিম পাগল করে, মহিম আলেয়া’কে ঘর ছাড়া করে।
আসন্ন সন্ধ্যার হালকা লালিমা চারি দিকে গাঢ় হয়ে আসছে। অন্ধকার দিবসকে গ্রাস করতে করতে প্রায় শেষান্তে। আশ-পাশের গাছ-গাছালী আর বন-বাদাড়ে আঁধার নেমে গেছে। এমন সময় গেলো কই, গেলো কই? -কে গেলো কই? কোথায় গেলো কে? কেউ যেন কাউকে বুঝিয়ে বলবার অবকাশ কিংবা অবসর নেই। সবার চোখেমুখে ব্যস্ততা বিষন্নতা। আবার সুযোগ সন্ধানীরা চাপা হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে এবং মুখ টিপে টিপে হাসছে। আমি অত্যধিক কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে তাদেরই আশ্রয় নিয়ে জানতে পারলাম, পাশের বাড়ির আলেয়া সন্ধ্যার এই আলো আঁধারি মাঝে গা ঢাকা দিয়েছে। কোথায় গেলো? কেন গেলো? আলেয়া’র মা বা বাড়ির বড়’রা দেখলাম বিষয়টা নিয়ে একেবারে অস্থির উদ্বিগ্ন না হয়ে তারা যেন উদ্ধারের পন্থা খুঁজছে। আমি যখনই রহস্য উদ্ঘাটনে মনোযোগী হচ্ছি ঠিক তখনই, এ যেন সময়ের সঠিক নির্বাচন। মহিমের এক প্রিয় বন্ধু প্রদীপ। হঠাৎ আলেয়া’র বাড়ির উঠোনে হতাশা আর ব্যঞ্জনাময় পরিস্থিতির মধ্যে এসে উপস্থিত হয়। -‘ব্যবস্থা হবে ব্যবস্থা হবে,’ সে সকলকে এমন এক অভয় বাণী শুনিয়ে ধপাস করে বাঁধানো বারান্দায় বসে যায়।
প্রদীপ’র ওপর সকলের বিস্ময়কর অপলক দৃষ্টি। প্রদীপ উপস্থিত সবাইকে জানায় যে, তার কাছে সমস্যা সমাধানের পথ আছে। যদি কেউ তার কথা অবহেলা বা অবজ্ঞা করেন তবে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। কথা শুনা মাত্র সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, Ñ‘আরে বাবা ভূমিকা রাখ্, আগে বল ব্যাপার কি? কি হয়েছে? আলেয়া কোথায়, সে কোথায়? তুই কি জানিস ওরা কোথায়?’ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। প্রদীপ সবাইকে শান্ত হতে আবারও অনুরোধ জানিয়ে বিষয়টা যে খুব জটিল এমন একটা প্রগাঢ় ভাব তার চেহারার মধ্যে রেখেই সে আস্তে আস্তে তার বুকপকেট থেকে একখানা চিঠি বের করে। এবং চিঠিখানা কান খুলে শুনে হৃদয়ঙ্গম করবার জন্যে সবাইকে এক ধরনের শাসনের সুরেই আবেদন রাখে এবং সে চিঠিখানা পড়তে শুরু করে, – ‘প্রিয় বন্ধু প্রদীপ, – তোর কাছে প্রাণঢালা ভালোবাসা থাকলো। হয়তো এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অবস্থায় এই চিঠিখানাই হবে সর্বশেষ কারো কাছে লিখা চিঠি। জানি না কপালে কি লিখা আছে । তবে সিদ্ধান্তটি যে অবশ্যই চুড়ান্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রদীপ, – আমি আর আলেয়া এখন মধুন টিলায়! আর আমরা আসার সময় একটি বড় টেক্সই মজবুত পর্যাপ্ত লম্বা রশি নিয়ে এসেছি, – সুতরাং বুঝতেই পারছিস। আমাদের রাখালকে দিয়ে তোর কাছে এই চিঠিখানি পাঠিয়ে দিলাম এর মানে এই নয় যে, তুই মধুর টিলায় এসে ঘেনঘেন করে আমাদেরকে নতুন করে বুঝাতে হবে। ওখানে তুই একা আসলে বরং সমুহ ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, – বুঝলি? এই পত্র পাওয়া মাত্র আমার মা, ভাই এবং আলেয়া’র মা’কে গিয়ে পত্রে লিখা শর্তটি শুনিয়ে দিবে, কেমন? আর শুন, তুই যদি এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিস তা হলে ভেবে দেখ, এই জোড়া খুনের দায়ী কিন্তু তুই-ই হবে! আর কেউ নয়। আমি ও আলেয়া এখন মধুর টিলায় অবস্থান করছি। আমাদের গুরুজনরা নির্দিষ্ট সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে আমরা দু’জন নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী। অথচ, – আমরাও আরো দশজন মানুষের মতো এই সুন্দর দুনিয়ার বুকে বাঁচতে চাই, সংসার করে সংসারী হতে চাই, ভবিষ্যতে কচি-কাঁচার মুখ দেখতে চাই, ওদের রাঙা নরম তুলতুলে গালে আদর চুম্বন মাখতে চাই; যেমন করে একদিন মেখে ছিলেন আমাদের মা-বাবা’রা আমাদেরই আতপ্ত ললাটে। অথচ আমাদের বেলায় তারা তা হতে দিচ্ছেন না। কিন্তু আমরা একে অন্যকে না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে, ভিতরে তুষের আগুন নিয়ে এ জগতে বাঁচতে চাই না। আমরা মুহুর্তের জন্যেও আর বিচ্ছেদ-বিরহে কাঁদতে চাই না। বাঁচতে হলে উভয় উভয়েরই বুকের মাঝে মাথা রেখে বাঁচতে চাই, আগুনের বদলে জলজ শান্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আর যদি তাঁরা আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, – প্রদীপ তুই বলে দিবি, এখন একটি মাত্র পথ তাঁদের সামনে খুলা আছে। সেটি হচ্ছে আজ রাত আট’টা ত্রিশ মিনিটের মধ্যে একজন মৌলভী সাহেবকে নিয়ে এই মধুর টিলায় এসে উপস্থিত হয়ে আমাদের (আমি মহিম আর সে আলেয়া) উভয়কে কবুল পড়িয়ে যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়ে আরো কতোটা কাল এই বসুধার বুকে বাঁচার সুযোগ দেন, তবেই বেঁচে গিয়ে চিরটা কাল তাঁদের কৃতঞ্জতা জানাবো এবং অপরিশোধিত ঋণের ভারে আমরণ আরো নূয়ে থাকবো। আর আমাদের এই আবেদনের অবমাননা বা আমাদের উদ্যোগকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করবার অপচেষ্টা করতে গেলে, পরিণাম যা হবে তা হচ্ছে, – আমরা তো এখন মধুর টিলার প্রকান্ড হিজল গাছে ওঠে তার বড় শাখার প্রান্তসীমায় বসে আছি, দক্ষিণ প্রান্তের ডালে রশি দিয়ে মৃত্যুফাঁদও তৈরী করে রেখেছি; সময় হলেই যেখান থেকে আমরা দু’জন ফাঁসিতে ঝুলে পড়বার জন্যে। সুতরাং ব্যতিক্রম হলে ঝুলেই পড়বো। অতএব, তাঁরা তাঁদের সুন্দর সিদ্ধান্তটা নিয়ে আটটা ত্রিশ মিনিটের পূর্বেই আসবেন এই প্রত্যাশা বুকের মাঝে ধারণ করে আমরা রইলাম তীব্র প্রতিক্ষায় তাঁদের পথপানে চেয়ে। – প্রদীপ, তোমরা সবার যেন মনে থাকে, আটটা একত্রিশ মিনিট হলেই আমাদের ঝুলন্ত লাশ দর্শনে সবাইকে চিৎকার করতে হবে! আহাজারি করতে হবে! অথচ পৃথিবীর কোন শক্তিই তখন আর তাঁদের বুকে আমাদেরকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সকলেরই আরো মনে রাখা উচিৎ, সুযোগ জীবনে বার বার আসে না, একবার আসে আর একবারই যায়। আবারও জানিয়ে দিচ্ছি সময়সীমা কিন্তু; একত্রিশ নয়; আট’টা ত্রিশ।’ – ইতি/ তোর-ই বন্ধু / মহিম উদ্দিন।”
চিঠি পড়া শেষ হতেনা হতেই আলেয়া’র মা এবং মহিম’র মা আর বড় ভাই স্বতঃস্ফুর্ত সম্মতি দিয়ে ব্যতিব্যস্থ হয়ে ওঠেন। কালবিলম্ব না করে মসজিদের ঈমাম সাহেবকে ডেকে পাঠান। ঈমাম সাহেব তখন এশা’র নামাজের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমন সময় এ ধরনের বিচিত্র সংবাদ শুনে ক্ষণকাল তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাথর! তারপর ঈমাম সাহেব তড়িঘড়ি করে ছুটে আসেন। মধুর টিলা অভিমুখে ঈমাম সাহেব ছুটতে থাকেন আগে আগে, আর প্রেমিক প্রেমিকার অভিবাবক’রা এবং পাড়া প্রতিবেশী’রা দল বেঁধে ছুটতে থাকে পিছু পিছু। সকলেরই আপ্রাণ চেষ্টা, কিছুতেই যেন আট’টা একত্রিশ না বাজে। সবাই দৌড়াতে দৌড়াতে আট’টা আটারো মিনিটের সময়ই পৌছে যায় গন্তব্যে, মধুর টিলায় হিজল গাছের তলায়। জ্যোৎস্নার আলোয় তাদের অবস্থানের অবস্থাটা খুব পরিষ্কার দেখা না যাওয়াতে টর্চ লাইট দিয়ে খুঁজে দখতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে অল্পক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ দেখা যায়, সত্যি সত্যি ওরা দু’জনই হিজল গাছে উঠে তার একটি উঁচু ডালে রশিটা পেঁচিয়ে ঝুলিয়েছে, এবং রশির শেষ প্রান্তে শক্ত গাঁট দিয়ে বড় করে দু’জনের মাথা ঢুকার মতো আয়তনে একটা মৃত্যুফাঁদ তৈরী করে ঐ প্রান্তটা মহিম’র হাতেই রেখেছে। অর্থাৎ মৃত্যুর জন্যে তারা দু’জনই দ্বিধাহীন পূর্ণ প্রস্তুত। উপস্থিত লোকজন যদি কাছে গিয়ে তাদেরকে কব্জা করে ধরে নিয়ে আসে, এধরনের সন্দেহ প্রবণ হয়ে মহিম চিৎকার করে করে হুসিয়ারী সংক্ষেত দিয়ে বার বার জানিয়ে দিচ্ছে, – ‘চল্লিশ হাত দূরে থাকুন, দুই নম্বরী কিছু করবার চেষ্টা করবেন না। কাছে আসবেন না, দূরে থেকে কবুল পড়ান। নতুবা এই চেয়ে দেখুন।’ বলতে বলতে মহিম ও আলেয়া দড়িটির ফাঁদে উভয়েই মাথা ঢুকিয়ে নিলো। তাদের এমন দুঃসাহসীক লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে আলেয়া’র মা ভয়ে আতঙ্কে অস্থির হয়ে চিৎকার করতে করতে মৌলবী সাহেবকে বলছেন, Ñ‘কি হলো মৌলবীসাব, কবুল পড়াচ্ছেন না কেন? আপনার হয়েছেটা কী? টাকা পয়সার চিন্তা করবেন না, ওটা আমি আপনাকে বোনাস সহ পরিশোধ করবো। কি হলো আর দেরী করছেন কেন?’ আলেয়া’র মা আবার চেঁচিয়ে উঠে বললেন, – ‘কী হয়েছে আপনার? আপনার কি ওজু নাই। থাকে না না থাকুক, কবুল পড়ান।’ মৌলবী সাহেব তৎক্ষণাৎ আসতাগ্ফিরুল্লা পড়তে পড়তে জঙ্গলের ভিতরেই ঘাসের ওপর হুট্ করে বসে পড়লেন এবং উচ্চ স্বরে সুর করে করে বিয়ের কালেমা পড়িয়ে আলেয়া এবং মহিমকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়ে সবাইকে শুভমুক্তি দিলেন।
কবুল পড়া শেষ হওয়া মাত্রই ওরা দু’জন গাছ থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে যে ভাবে একে অন্যকে অক্টোপাশের মতো জড়িয়ে ধরে ছিলো, দেখে মনে হয়েছিলো তারা যেন অনন্তকাল আর কেউ কাউকে কিছুতেই ছাড়বে না। শুক্ল পক্ষের ভরা জ্যোৎস্না মহিম আর আলেয়া’র চোখে মুখে তখন হিলারী আর তেনজিং এর বিজয় হাসির মতো তৃপ্ত হাসির উদ্ভাস ফুটিয়ে দিলো। সে দিন সেই রাতে, Ñমধুর টিলার গভীর বনের গাছ, লতা-পাতা, ফুল-পতঙ্গ, নীড়ের নিরব পাখি সকলই যেন আলেয়া আর মহিম’র মিলন স্বীকৃতির জন্যে এতোক্ষণ প্রাণময় প্রতিক্ষায় অধীর ছিলো।
অটোয়া, কানাডা।
E-mail:-hasibporobashi@sympatico.com